একজন অবিশ্বাসীর বিশ্বাস

প্যারাডক্সিকাল সাজিদ বই থেকে নেওয়া....

আমি রুমে ঢুকেই দেখি সাজিদ কম্পিউটারের সামনে উবু হয়ে বসে আছে। খটাখট কি যেন টাইপ করছে হয়তো। আমি জগ থেকে পানি ঢালতে লাগলাম। প্রচন্ড রকম তৃষ্ণার্তা। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাবার জোগাড়। সাজিদ কম্পিউটার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললে,- “কি রে, কিছু হইলো?" আমি হতাশ গলায় বললাম,- 'নাহি।" – তার মানে তোকে একবছর ড্রপ দিতেই হবে? - সাজিদ জিজ্ঞেস করলো। আমি বললাম,- “কি আর করা। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।' সাজিদ বললো,- "তোদের এই এক দোষ, বুঝলি? দেখছিস পুওর এ্যাটেন্ডেন্সের জন্য এক বছর ড্রপ খাওয়াচ্ছে, তার মধ্যেও বলছিস, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। ভাই, এইখানে কোন ভালোটা তুই পাইলি, বলতো?"
সাজিদ সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া দরকার। আমি আর সাজিদ রুমমেট। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রো বায়োলজিতে পড়ে।প্রথম জীবনে খুব ধাৰ্মিক ছিলো। নামাজকালাম করতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কিভাবে কিভাবে যেন এগনোষ্টিক হয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে স্রষ্টার উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে এখন পুরোপুরি নাস্তিক হয়ে গেছে। ধর্মকে এখন সে আবর্জনা জ্ঞান করে। তার মতে পৃথিবীতে ধর্ম এনেছে মানুষ। আর "ইশ্বর ধারনাটাই এইরকম স্বার্থন্বেষী কোন মহলের মস্তিষ্কপ্রসূত। সাজিদের সাথে এই মূহুর্তে তর্কে জড়বার কোন ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু তাকে একদম ইগনোর করেও যাওয়া যায়না। আমি বললাম,- 'আমার সাথে তো এর থেকেও খারাপ কিছু হতে পারতো, ঠিক না?" – আরে, খারাপ হবার আর কিছু বাকি আছে কি?"
-- 'হয়তো।”
– যেমন?"– এরকমও তো হতে পারতো, ধর, আমি সারাবছর একদমই পড়াশুনা করলাম না। পরীক্ষায় ফেইল মারলাম। এখন ফেইল করলে আমার এক বছর ড্রপ যেতো। হয়তো ফেইলের অপমানটা আমি নিতে পারতাম না। আত্মহত্যা করে বসতাম।" সাজিদ হা হা হা হা করে হাসা শুরু করলো। বললে,- “কি বিদঘুটে বিশ্বাস নিয়ে চলিস রে ভাই।"
এই বলে সে আবার হাসা শুরু করলো। বিদ্রুপাত্মক হাসি।
রাতে সাজিদের সাথে আমার আরো একদফা তর্ক হলো। সে বললো,-- আচ্ছা, তোরা যে স্রষ্টায় বিশ্বাস করিস, কিসের ভিত্তিতে?" আমি বললাম,- 'বিশ্বাস দু ধরনের। একটা হলো, প্রমানের ভিত্তিতে বিশ্বাস। অনেকটা, শর্তারোপে বিশ্বাস বলা যায়। অন্যটি হলো প্রমান ছাড়াই বিশ্বাস। সাজিদ হাসলো। সে বললো,- 'দ্বিতীয় ক্যাটাগরিকে সোজা বাঙলায় অন্ধ বিশ্বাস বলে রে আবুল, বুঝলি?" 
আমি তার কথায় কান দিলাম না। বলে যেতে লাগলাম"প্রমানের ভিত্তিতে যে বিশ্বাস, সেটা মূলত বিশ্বাসের মধ্যে পড়েনা।পড়লেও, খুবই ট্যাম্পোরেরি। এই বিশ্বাস এতই দূর্বল যে, এটা হঠাৎ হঠাৎ পালটায়।" সাজিদ এবার নড়েচড়ে বসলো। সে বললো,- 'কি রকম?" আমি বললাম,- 'এই যেমন ধর, সূর্য আর পৃথিবীকে নিয়ে মানুষের একটি আদিম কৌতুহল আছে। আমরা আদিকাল থেকেই এদের নিয়ে জানতে চেয়েছি, ঠিক না?" - 'হু, ঠিক।"
- "আমাদের কৌতুহল মেটাতে বিজ্ঞান আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে, ঠিক?"
- হ্যাঁ - "আমরা একাট্ট ছিলাম। আমরা নির্ভুলভাবে জানতে চাইতাম যে, সূর্য আর পৃথিবীর রহস্যটা আসলে কি। সেই সুবাধে, পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা নানান সময়ে নানান তত্ব আমাদের সামনে এনেছেন।
পৃথিবী আর সূর্য নিয়ে প্রথম ধারনা দিয়েছিলেন গ্রিক জ্যোতির বিজ্ঞানি টলেমি। 
টলেমি কি বলেছিলো সেটা নিশ্চয় তুই জানিস?" সাজিদ বললো,- 'হাঁ। সে বলেছিলা সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে। - 'একদম তাই।
কিন্তু বিজ্ঞান কি আজও টলেমির থিওরিতে বসে আছে? নেই। কিন্তু কি জানিস, এই টলেমির থিওরিটা বিজ্ঞান মহলে টিকে ছিলো পুরো ২৫০ বছর। ভাবতে পারিস? ২৫০ বছর পৃথিবীর মানুষ, যাদের মধ্যে আবার বড় বড় বিজ্ঞানি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ছিলো, তারাও বিশ্বাস করতো যে, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে।এই ২৫০ বছরে তাদের মধ্যে যারা যারা মারা গেছে, তারা এই বিশ্বাস নিয়েই মারা গেছে যে, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে।'
সাজিদ সিগারেট ধরালো।
সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো,- তাতে কি? তখন তো আর টেলিস্কোপ ছিলো না, তাই ভুল মতবাদ দিয়েছে আর কি। 
পরে নিকোলাস কোপারনিকাস এসে তার থিওরিকে ভুল প্রমান করলো না?" — 'হাঁ। 
কিন্তু কোপারনিকাসও একটা মন্তবড় ভুল করে গেছে।" সাজিদ প্রশ্ন করলো,- 'কি রকম?" - অদ্ভুত এটা তো তোর জানার কথা।
যদিও কোপারনিকাস টলেমির থিওরির বিপরীত থিওরি দিয়ে প্রমান করে দেখিয়েছিলেন যে, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘোরে। কিন্তু, তিনি এক জায়গায় ভুল করেন। এবং সেই ভুলটাও বিজ্ঞান মহলে বীরদৰ্পে টিকে ছিলো গোটা ৫০ বছর।
– কোন ভুল?" - উনি বলেছিলেন, পৃথিবীই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে, কিন্তু সূর্য ঘোরে না। সূর্য স্থির। কিন্তু আজকের বিজ্ঞান বলে, - নাহ, সূর্য স্থির নয়।
সূর্যও নিজের কক্ষপথে অবিরাম ঘূর্ণনরত অবস্থায়।" সাজিদ বললো,- 'সেটা ঠিক বলেছিস। কিন্তু বিজ্ঞানের এটাই নিয়ম যে, এটা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হবে। এখানে শেষ বা ফাইনাল বলে কিছুই নেই।' 
- 'একদম তাই। বিজ্ঞানে শেষ/ফাইনাল বলে কিছু নেই। একটা বৈজ্ঞানিক থিওরি ২ সেকেন্ডও টেকে না, আবার আরেকটা ২০০ বছরও টিকে যায়। তাই, প্রমান বা দলিল দিয়ে যা বিশ্বাস করা হয় তাকে আমরা বিশ্বাস বলিনা।
এটাকে আমরা বড়জোর চুক্তি বলতে পারি। চুক্তিটা এরকম, – তোমায় ততোক্ষণ বিশ্বাস করবো, যতক্ষণ তোমার চেয়ে অথেনটিক কিছু আমাদের সামনে না। আসছে।"সাজিদ আবার নড়েচড়ে বসলো।
সে কিছুটা একমত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আমি বললাম,- 'ধর্ম বা সৃষ্টিকর্তার ধারনা/অস্তিত্ব হচ্ছে ঠিক এর বিপরীত। দাখ, বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যকার এই গৃঢ় পার্থক্য আছে বলেই আমাদের ধর্মগ্রন্থের শুরুতেই বিশ্বাসের কথা বলা আছে।
বলা আছে- ‘এটা তাদের জন্য যারা বিশ্বাস করে।' (সূরা বাকারা, ০২)।যদি বিজ্ঞানে শেষ বা ফাইনাল কিছু থাকতো, তাহলে হয়তো ধর্মগ্রন্থের শুরুতে বিশ্বাসের বদলে বিজ্ঞানের কথাই বলা হতো। হয়তো বলা হতো,- এটা তাদের জন্যই যারা বিজ্ঞানমনষ্ক।" কিন্তু যে বিজ্ঞান সদা পরিবর্তনশীল, যে বিজ্ঞানের নিজের উপর নিজেরই বিশ্বাস নেই, তাকে কিভাবে অন্যরা বিশ্বাস করবে?" সাজিদ বললে,- 'কিন্তু যাকে দেখিনা, যার পক্ষে কোন প্রমান নেই, তাকে কি করে আমরা বিশ্বাস করতে পারি?” পারেনা। 
এটা বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, সৃষ্টিকর্তার নয়। বিজ্ঞান অনেক কিছুরই উত্তর দিতে পারেনা। লিষ্ট করতে গেলে অনেক লম্বা একটা লিষ্ট করা যাবে।" সাজিদ রাগি রাগি গলায় বললে,- "ফাইজলামো করিস আমার সাথে?" আমি হাসতে লাগলাম। বললাম,- "আচ্ছা শোন, বলছি। তোর প্রেমিকার নাম মিতু না?' 
- এইখানে প্রেমিকার ব্যাপার আসছে কেন?- “আরে বল না আগে”
- "হ্যাঁ।" - "কিছু মেন করিস না। কথার কথা বলিছ। ধর, আিম মিতুকে ধর্ষণ করলাম। রক্তাক্ত অবস্থায় মিতু তার বেড়ে পড়ে আছে। আরো ধর, তুই কোনভাবে ব্যাপারটা জেনে গেছিস ।"
- 'হু।" - 'এখন বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা দেখি, মিতুকে ধর্ষণ করায় কেনো আমার শাস্তি হওয়া দরকার?" সাজিদ বললো,- 'ক্রিটিক্যাল কোয়েশ্চান। এটাকে বিজ্ঞান দিয়ে কিভাবে ব্যাখ্যা করবো?" 
- 'হা হা হা। আগেই বলেছি। এমন অনেক ব্যাপার আছে, যার উত্তর বিজ্ঞানে নেই।" - "কিন্তু এর সাথে স্রষ্টায় বিশ্বাসের সম্পর্ক কি?" - '' সম্পর্ক আছে। স্রষ্টায় বিশ্বাসটাও এমন একটা বিষয়, যেটা আমরা, মানে মানুষেরা, আমাদের ইন্দ্ৰিয় গ্রাহ্য প্রমানাদি দিয়ে প্রমান করতে পারবো না। স্রষ্টা কোন টেলিস্কোপে ধরা পড়েন না। উনাকে অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়েও খুঁজে বের করা যায়না। উনাকে জাষ্টি "বিশ্বাস করে নিতে হয়।" সাজিদ এবার ১৮০ ডিগ্রি এঙ্গেলে বেঁকে বসলো। সে বললো,- 'ধুর! কি সব বাল ছাল বুঝালি। যা দেখিনা, তাকে বিশ্বাস করে নেবো?" আমি বললাম,- 'হাঁ। পৃথিবীতে অবিশ্বাসী বলে কেউই নেই। সবাই বিশ্বাসী। সবাই এমন কিছু না কিছুতে ঠিক বিশ্বাস করে, যা তারা আদৌ দেখেনি বা দেখার কোন সুযোগও নেই।কিন্তু এটা নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলে না। তারা নির্বিম্নে তাতে বিশ্বাস করে যায়। তুইও সেরকম।" সাজিদ বললো,- 'আমি? পাগল হয়েছিস? আমি না দেখে কোন কিছুতেই বিশ্বাস করিনা, করবোও না।"
– “তুই করিস। এবং, এটা নিয়ে তোর মধ্যে কোনদিন কোন প্রশ্ন জাগে নি। এবং, আজকে এই আলোচনা না করলে হয়তো জাগতোও না।" সে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। বললাম,- "জানতে চাস?”— ‘আবার বলছি, কিছু মনে করিস না। যুক্তির খাতিরে বলছি।"
- বল।
- "আচ্ছা, তোর বাবা-মা'র মিলনেই যে তোর জন্ম হয়েছে, সেটা তুই দেখেছিলি? বা, এই মূহুর্তে কোন এভিডেন্স আছে তোর কাছে? হতে পারে তোর মা তোর বাবা ছাড়া অন্য কারো সাথে দৈহিক সম্পর্ক করেছে তোর জন্মের আগে। 
হতে পারে, তুই আই ব্যক্তিরই জৈব ক্রিয়ার ফল। তুই এটা দেখিস নি। কিন্তু কোনদিনও কি তোর মাকে এটা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলি? করিস নি। সেই ছোটবেলা থেকে যাকে বাবা হিসেবে দেখে আসছিস, এখনো তাকে বাবা ডাকছিস। যাকে ভাই হিসেবে জেনে আসছিস, তাকে ভাই। বোনকে বোন। তুই না দেখেই এসবে বিশ্বাস করিস না? কোনদিন জানতে চেয়েছিস তুই এখন যাকে বাবা ডাকছিস, তুই আসলেই তার ঔরসজাত কিনা? জানতে চাস নি। বিশ্বাস করে গেছিস। এখনো করছিস। ভবিষ্যতেও করবি। 
স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসটাও ঠিক এমনই রো। এটাকে প্রশ্ন করা যায়না। সন্দেহ করা যায়না। এটাকে হৃদয়ের গভীরে ধারন করতে হয়। এটার নামই বিশ্বাস।”সাজিদ উঠে বাইরে চলে গেলো। ভাবলাম, সে আমার কথায় কষ্ট পেয়েছে হয়তো। পরেরদিন ভোরে আমি যখন ফজরের নামাজের জন্য অযূ করতে যাব আমার পাশে সাজিদ এসে দাঁড়িয়েছে। আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। সে আমার চাহনির প্রশ্নটা বুঝতে পেরেছে। সে বললো,- 'নামাজ পড়তে উঠেছি।"
প্যারাডক্সিকাল সাজিদ বই থেকে নেওয়া....
প্যারাডক্সিকাল সাজিদ বইটি ঘরে বসে অর্ডার কর‍তে পারেন রকোমারিতে, বইয়ের লিংক, মূল্য ২৩০

Post a Comment

0 Comments