লেখা পড়া নিয়ে কিছু কথা

 

১.

কয়েকদিন আগে আমাদের দেশের লেখাপড়ার জগৎটিতে একটা বড় ওলটপালট হয়ে গেছে। আমার ধারণা, দেশের বেশিরভাগ মানুষ সেটা লক্ষ্য করেনি। বিষয়টা বলার আগে সবাইকে একটু পুরনো দিনের কথা মনে করিয়ে দিই।

লেখাপড়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে পরীক্ষা আর পরীক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে পরীক্ষার ফল। মুখে আমরা যতই বিদ্যা শিক্ষা বা জ্ঞানার্জনের কথা বলি, দেশের ছেলেমেয়েরা খুব সঙ্গত কারণেই লেখাপড়া করে পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য। এর মাঝে দোষের কিছু নেই। আসলে এই কারণে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর কাজটি খুব সহজ হয়ে যাওয়ার কথা। যেহেতু ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য খুবই ব্যস্ত, তাই পরীক্ষা পদ্ধতিটি যদি খুব ভালো হয়, তাহলে তারা নিজে থেকেই নিজের গরজে ভালো লেখাপড়া করে ফেলে। আর পরীক্ষা পদ্ধতি যদি খারাপ হয়, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যায়। এ জন্য যখন এ দেশে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হতে শুরু করেছিল, তখন আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল।

পরীক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে পরীক্ষার ফল। তাই ফলটি কীভাবে প্রকাশ করা হয় সেটা নিয়ে সারা পৃথিবীর সব শিক্ষাবিদই অনেক মাথা ঘামিয়েছেন। আমাদের দেশে আগে পরীক্ষার ফল তিনটি ভাগে ভাগ করা হতো – প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ এবং তৃতীয় বিভাগ। শতকরা ৭৫ ভাগ থেকে বেশি মার্কস পেলে সেটাকে বলা হতো স্টার মার্ক। এক-দুই বিষয়ে ফেল করার পর শুধু সেই বিষয়ে পরে আলাদা পরীক্ষা দিয়ে পাস করার উপায় ছিল। যতদূর মনে পড়ে, সেটার নাম ছিল রেফার্ড! কাজেই বলা যেতে পারে, যারা পাস করেছে তাদের পরীক্ষার ফল পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হতো – স্টার মার্ক, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং রেফার্ড। কেউ কোনো বিষয়ে শতকরা ৮০ মার্কস থেকে বেশি পেলে সেটাকে বলা হতো লেটার মার্কস। যারা ফাটাফাটি ধরনের ভালো ছাত্র ছিল তারা পাঁচ-ছয় বিষয়ে লেটারসহ স্টার মার্কস পেত। তাদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না এবং সবাই তাদেরকে সমীহ নিয়ে দেখত।

সব ছাত্রছাত্রী যেহেতু তাদের সব বিষয়ের নম্বর জানত তাই সারা বোর্ডে কে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে, সেটা খুব হইচই করে জানানো হতো। যারা প্রথম বিশজনের মাঝে থাকত তাদেরকে বলা হতো ‘স্ট্যান্ড’ করেছে। কোন স্কুল থেকে কতজন স্ট্যান্ড করেছে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার পরদিন সব খবরের কাগজে বোর্ডে কারা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছে তাদের ছবি ছাপা হতো বাবা-মায়ের সঙ্গে। তারা লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে থাকত এবং তারা কীভাবে এই বিশাল কৃতিত্ব অর্জন করেছে, সেটা নিয়ে সাংবাদিকরা তাদের প্রশ্ন করতেন (আমার বড় ভাই হুুমায়ূন আহমেদ রাজশাহী বোর্ডে দ্বিতীয় হয়েছিল। সে কারণে রেডিওতে তার নাম বলেছিল। নিজের কানে রেডিওতে নিজেদের একজনের নাম শুনে আমাদের প্রায় হার্ট অ্যাটাকের মতো অবস্থা হয়েছিল)।

যাই হোক যারা লেখাপড়া করান তারা খুব ভালো করে জানেন যে, একটা ছেলে বা মেয়ের পরীক্ষার খাতায় নম্বর হিসেবে একটা সুনির্দিষ্ট সংখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। সত্যি কথা বলতে কি, একজন শিক্ষককে যদি একই খাতার বান্ডিল দু’বার দেখতে হয়, তাহলে তারা দু’বার দুই রকম নম্বর দেবেন। দু’বারই অবশ্য যারা ভালো করেছে তারা ভালো নম্বর পাবে এবং যারা খারাপ করেছে, তারা খারাপ নম্বর পাবে; কিন্তু কোনোভাবেই হুবহু একই নম্বর পাবে না (শুধু বহু নির্বাচনী কিংবা গণিত বিজ্ঞানের কিছু জায়গায় সেটি সম্ভব; কিন্তু আমি সাধারণভাবে সাধারণ পরীক্ষার কথা বলছি)। শিক্ষাবিদরা যেহেতু জানেন যে, একটা পরীক্ষায় একেবারে সুনির্দিষ্ট নম্বর দেওয়া সম্ভব নয়। তাই তারা নম্বর থেকে গ্রেডে সরে এসেছেন। এখন বলা যায়, পৃথিবীর কোথাও পরীক্ষায় নম্বর দেওয়া হয় না, তার বদলে একটি গ্রেড দেওয়া হয়। যদি নম্বর দেওয়া হয় তাহলে আমাকে ধরে নিতেই হবে, যে ৮১ পেয়েছে সে যে ৮০ পেয়েছে তার থেকে নিশ্চয়ই ভালো। কিন্তু যদি গ্রেড দেওয়া হয় তাহলে তারা দু’জনেই একই গ্রেড পাবে এবং আমরা ধরে নেব দু’জনেই একই রকম ভালো এবং সেটাই অনেক যুক্তিযুক্ত।

কাজেই যখন আমাদের দেশে পরীক্ষার পদ্ধতি গ্রেডিংয়ে চলে এলো, তখন আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু শুরুতেই একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আগে থেকেই গ্রেডিং পদ্ধতি ছিল। সারাদেশের সব গ্রেডিং পদ্ধতি একই ধরনের হবে, সবাই আমরা সেটা আশা করেছিলাম; কিন্তু অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, সেটা ঘটল না। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের সঙ্গে মিল রেখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বোচ্চ গ্রেডিং ছিল চার। আমরা দেখলাম, এসএসসি ও এইচএসসিতে সর্বোচ্চ গ্রেড হচ্ছে পাঁচ। একই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শুরুতেই গ্রেডিংটা ভিন্ন করে দেওয়া হলো। কেন এটি করা হলো সেটি আমার কাছে একটা রহস্য।
শুধু যে সর্বোচ্চ গ্রেড ভিন্ন তা নয়, আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করলাম, প্রতি দশ মার্কসের জন্য গ্রেড পয়েন্ট কখনও এক কমেছে, কখনও কমেছে অর্ধেক অর্থাৎ ৮০ মার্কস পেলে গ্রেড পয়েন্ট হচ্ছে পাঁচ, দশ মার্কস কম ৭০ পেলে গ্রেড পয়েন্ট এক কমে চার, আরও দশ মার্কস কম পেলে গ্রেড পয়েন্ট আরও এক কমে তিন না হয়ে হঠাৎ করে সাড়ে তিন। অর্থাৎ গ্রেড পয়েন্ট আর পরীক্ষার মার্কসের সম্পর্ক সরল (linear) নয়, এটি জটিল। এর পেছনে যদি কোনো যুক্তি থাকে তাহলে খুব ভালো কিন্তু আমি কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না।

তবে যে বিষয়টা সবার জন্যই একটা সমস্যা করেছে, সেটা হচ্ছে গ্রেড পয়েন্টের বিভাজন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফেল গ্রেড ছাড়াও নয়টি ভিন্ন ধাপ আছে। এসএসসি এবং এইচএসসিতে ধাপ মাত্র ছয়টি (A+, A, A-, B, C এবং D)। শুধু তাই নয়, যখন ঢালাওভাবে মার্কস দেওয়ার কালচার শুরু হলো, তখন কোনো ছাত্রছাত্রীকে আর গ্রেডের ভিত্তিতে বিভাজন করা সম্ভব নয়। এ প্লাস পেয়েও অনেক ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় টিকে যাওয়া দূরে থাকুক, পাস মার্কসটিও তুলতে পারে না। বিষয়টি পুরোপুরি হয়ে গেল আমাদের সময়ের মতো অর্থাৎ গ্রেড পয়েন্ট হচ্ছে বিভাগ, জিপিএ ফাইভ হচ্ছে স্টার মার্কস, জিপিএ ফোর ফার্স্ট ডিভিশন ইত্যাদি!

তখন এ দেশে একটা খুব বড় অন্যায় কাজ করা শুরু হলো। বিষয়টা এত অবিশ্বাস্য যে, আমাদের সেটা বিশ্বাস করতেই অনেক সময় লেগেছে। এ দেশে ছেলেমেয়েদের যদিও বলা হয়েছে, তাদের পরীক্ষার ফল দেওয়া হচ্ছে গ্রেড পয়েন্টে; কিন্তু নানা কাজে তাদের পরীক্ষার প্রকৃত নম্বরগুলো ব্যবহার করা শুরু হলো। ছেলেমেয়েদের কখনোই তাদের প্রকৃত নম্বর জানানো হয়নি। রাষ্ট্র তাদের কথা দিয়েছে পরীক্ষায় পাওয়া নম্বর নয়, ছয়টি গ্রেড পয়েন্ট হচ্ছে তাদের পরীক্ষার ফল কিন্তু সেই নম্বরগুলো ব্যবহার করে তাদের ভাগ্য নির্ধারণ হতে লাগল। দেখা গেল, দু’জন একই গ্রেড পয়েন্ট পেয়েছে কিন্তু একজন বৃত্তি পেয়েছে, অন্যজন পাচ্ছে না। কেন অন্যজন পাচ্ছে না সেটা সে কোনোদিন জানতেও পারবে না। কার কাছে এটা নিয়ে নালিশ করবে তারা জানে না। আমি লেখাপড়ার বিষয় নিয়ে পত্রপত্রিকার ওপর ভরসা করা সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিয়েছি। এ দেশে গাইডবই সম্পূর্ণভাবে বেআইনি হওয়ার পরও পত্রপত্রিকা নিয়মিতভাবে প্রতিদিন তাদের নিজস্ব গাইডবই ছাপিয়ে যাচ্ছে। এই সংবাদপত্রের ওপর কোন আশায় আমরা ভরসা করব?

ছাত্রছাত্রীদের অজানা পরীক্ষার নম্বর দিয়ে তাদের ভাষ্য নির্ধারণ করার সবচেয়ে ভয়াবহ রূপটি আমরা কিছুদিন হলো দেখেছি, যখন তাদেরকে বিভিন্ন কলেজে ভর্তি করানো শুরু হলো। আমাদের শিক্ষা সচিবের ব্যক্তিগত অ্যাডভেঞ্চারের ফলে পুরো বিষয়টি একেবারে লেজেগোবরে হয়ে গিয়েছিল, আমরা সেটা সবাই জানি। আমার সেটি নিয়ে বাড়তি কোনো অভিযোগ নেই। আমার সবচেয়ে বড় অভিযোগ, একটি ছেলে বা মেয়ে কোন কলেজে ভর্তি হতে পারবে তার সেই সৌভাগ্য (কিংবা দুর্ভাগ্য) নির্ধারণ করা হয়েছে তার পরীক্ষার নম্বরটি দিয়ে, যেটি সে জানে না। সেই নম্বর দিয়ে তার গ্রেড পয়েন্ট নির্ধারণ করা ছাড়া আর কিছু করার কথা ছিল না। একটা রাষ্ট্র তার ছেলেমেয়েদের ওপর এত বড় অবিচার করতে পারে, আমি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারি না।

আমার মতো আরও একজন নিশ্চয়ই বিষয়টা বিশ্বাস করতে পারেননি এবং তিনি সেটা নিয়ে আমার মতো পত্রপত্রিকায় কাদুনি না গেয়ে হাইকোর্টে রিট করে দিয়েছেন। হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন – যে কোনো ছাত্রছাত্রী বোর্ডের কাছে চাইলেই বোর্ড তাকে তার মার্কশিট দিতে বাধ্য থাকবে। অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীরা তার প্রকৃত নম্বর জানতে পারবে। কেউ যখন তার প্রকৃত নম্বরটি জানতে পারে, তখন গ্রেড পয়েন্টটির আর কোনো মূল্য থাকে না। আমার ধারণা, এখন এ দেশের সব ছেলেমেয়েই বোর্ডের কাছে তার প্রকৃত নম্বর চাইতে থাকবে এবং সবাই সেটা জানতে থাকবে। সাংবাদিকরা তাদের পত্রিকার গাইডবইয়ের বিরুদ্ধে একটা কথাও লেখেন না কিন্তু বোর্ড অফিসে ঘোরাঘুরি করে নিশ্চয়ই কোন ছেলে বা মেয়েটি সবচেয়ে বেশি মার্কস পেয়েছে সেটা বের করে ফেলবেন এবং আমরা আবার গর্বিত বাবা-মায়ের পাশে লাজুক মুখে দাঁড়ানো সর্বোচ্চ মার্কস পেয়ে ফাস্ট-সেকেন্ড হওয়া ছেলেমেয়েদের দেখতে থাকব।

খুবই সোজা কথায় বলা যায়, আমরা সামনের দিকে এগিয়ে না গিয়ে এক লাফে বিশ বছর পেছন দিকে চলে গেলাম। গ্রেড পয়েন্ট ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমরা পরীক্ষার নম্বরে ফিরে গেলাম!

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি। আর কেউ কি আমার সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন?

২.
কয়েকদিন আগে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে আমি ইন্টারভিউ দিচ্ছি। হঠাৎ করে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক আমাকে বললেন, ‘আপনি বহুদিন থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলে আসছেন। কিন্তু সেটি সত্যিই কি ঠিকভাবে নেওয়া কখনও সম্ভব হবে?’ আমি বললাম, যদি কখনও সেভাবে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় অবশ্যই সেটি সম্ভব হবে। কীভাবে সেটা নেওয়া যায়, আমি সেখানে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করিনি।

আমি বুঝতে শুরু করেছি, যে কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাধ্য করা না হলে এ দেশে কখনোই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু করা সম্ভব হবে না। তার কারণ হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের টাকার জন্য সর্বগ্রাসী লোভ! (আমি জানি, আমার এই বাক্যটি লেখার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমাকে কখনও ক্ষমা করবেন না কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার পর এক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কী পরিমাণ টাকা পান, তার একটি তালিকা প্রকাশ করলে আমার ধারণা, সবাই ব্যাপারটা বুঝে যাবেন)।

কখনোই সমন্বিত পরীক্ষা নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজি হবে না জেনেও এটি কীভাবে নেওয়া সম্ভব আমি দুই লাইনে বলে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি। ধরা যাক, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুরোধ করল, আপনারা ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষার নম্বরগুলো কি আমাদের ব্যবহার করতে দেবেন? ধরা যাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের ভর্তি পরীক্ষার নম্বর দিতে রাজি হলো। তখন আমরা সব ছাত্রছাত্রীকে বলব, তোমরা যারা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাও তারা আমাদের সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন করে রাখ কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দাও, আমরা তাদের থেকে তোমাদের পরীক্ষার নম্বর নিয়ে নেব। আলাদা আলাদা বিষয়ের নম্বরগুলো আমরা আমাদের মতো সাজিয়ে নিয়ম অনুযায়ী ভর্তি পরীক্ষার ফল ঘোষণা করব।

আমাদের দেখাদেখি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ও ঠিক একই প্রক্রিয়ায় তাদের ভর্তি পরীক্ষা সেরে নিতে পারবে। অর্থাৎ পরীক্ষা হলো একটি, কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সেই পরীক্ষার ফল ব্যবহার করে ফেলল! এটাই হচ্ছে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা। খুব মোটা দাগে এটি একটি উদাহরণ। সত্যি সত্যি করতে হলে এটাকে অনেক সূক্ষ্মভাবে পুরো প্রক্রিয়াটা আরও কার্যকরভাবে সাজানো সম্ভব।

এ দেশের ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে কখনোই সমন্বিত পরীক্ষার আয়োজন করা হবে বলে মনে হয় না। তবু মনে হলো কয়েকটা লাইন লিখি! ন্যাড়া বেলতলা যায় না কিন্তু দূর থেকে একটা বেলগাছ দেখতে তো কোনো দোষ নেই!

৩.
শুধু মন খারাপ করা কথা বলে বলে একটা লেখা শেষ করতে মন চাইছে না। তাই একটা মন ভালো করা কথা দিয়ে লেখাটা শেষ করি।

অনেক দিন থেকেই এই এলাকার স্কুলগুলো নিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা অনেক বড় অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। উদ্যোগটা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এটুআইয়ের। আমাদের সাহায্য করবে জেলা শিক্ষা অফিস আর আয়োজন করব আমরা। এ দেশে আজকাল স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে নানা ধরনের অলিম্পিয়াড হয়, বিজ্ঞান মেলা হয়, বিজ্ঞান কংগ্রেস হয় কিন্তু এটি ছিল সেগুলো থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই অনুষ্ঠানের লক্ষ্য হচ্ছে, স্কুলের ছেলেমেয়েদের দিয়ে গণিত আর বিজ্ঞান শিক্ষার উপকরণ তৈরি করিয়ে আনা। আজকাল তাদের পাঠ্যপুস্তকে অনেক এক্সপেরিমেন্টের কথা বলে দেওয়া থাকে। সেগুলো তারা নিজেদের মতো করে করতে পারে কিনা সেটাও আমরা দেখতে চাচ্ছিলাম। আমরা একশ’টা স্কুলের সঙ্গে যোগাযাগ করে তাদেরকে বলে দিলাম, একজন শিক্ষক আর দু’জন ছাত্র মিলে গণিত বা বিজ্ঞান শেখানোর জন্য কোনো একটা শিক্ষা উপকরণ তৈরি করে ১৯ আগস্ট ভোরবেলা যেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসে।

১৯ তারিখ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ দেখতে পেলাম সেই রাত থেকে যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে সেটি থেমে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই এবং মনে হচ্ছে, বুঝি আকাশ ফুটো করে বৃষ্টি এসে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। অনেক দূরদূরান্ত থেকে স্কুলের ছেলেমেয়েদের আসার কথা। এই বৃষ্টিতে আর কে আসবে? কেন আসবে?

আমরা কোনোভাবে আমাদের আয়োজনের জায়গায় হাজির হয়ে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলম, এই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে স্কুলের ছেলেমেয়েরা আসতে শুরু করেছে। যেসব স্কুলের টাকাপয়সা আছে, তারা মাইক্রোবাস কিংবা গাড়িতে আসছে। যাদের অবস্থা তত ভালো নয় তারা সিএনজি করে আসছে। আমরা মনে মনে হিসাব করে রাখলাম, অর্ধেক ছেলেমেয়ে এলেই আমরা খুশি মনে সেটা মেনে নেব।

বিল্ডিংয়ের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের প্রচণ্ড বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি অবাক হয়ে দেখলাম, এই বৃষ্টিতেও ছেলেমেয়েদের আসায় কোনো ভাটা পড়ছে না এবং নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আমরা আবিষ্কার করলাম, আমরা যতজন ছাত্রছাত্রী আশা করেছিলাম তার দ্বিগুণ সংখ্যক ছেলেমেয়ে চলে এসেছে। যাদেরকে খাবার, টি-শার্ট এসব বিষয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তারা কপালে আক্ষরিক অর্থে করাঘাত করতে করতে বলল, ‘এখন কী হবে? এতগুলো বাচ্চাকে কী খেতে দেব?’

আমি তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘বেশি ছেলেমেয়ে না হয়ে যদি মাত্র অল্প কিছু ছেলেমেয়ে আসত তোমরা কি খুশি হতে?’ তারা বলল, খুশি হতো না। আমি বললাম, ‘যা খাবার আছে সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খেয়ে নেব। এখন এই বাচ্চাদের কাজকর্মগুলো ঘুরে ঘুরে দেখি!’

বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি যখন পৃথিবীকে ভাসিয়ে নিচ্ছে, তখন আমরা সবাই মিলে ঘুরে ঘুরে একশ’টি স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিজেদের হাতে তৈরি কয়েকশ’ গণিত আর বিজ্ঞানের শিক্ষা উপকরণগুলো দেখলাম। ছাত্রছাত্রীদের নিজ হাতে তৈরি করা শিক্ষা উপকরণ দেখে যত আনন্দ পেয়েছি, তার থেকে অনেক বেশি আনন্দ পেয়েছি ছেলেমেয়েদের আগ্রহ, উৎসাহ আর উত্তেজনা দেখে। সেই আনন্দের সঙ্গে আছে সেলফি আর অটোগ্রাফের আনন্দ। অনেকদিন পর আমি এ রকম মজার সময় কাটিয়েছি।

বলাই বাহুল্য, প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে আমাদের পুরো আয়োজন কোনোটাই ঠিক করে কাজ করেনি। সবকিছু অল্প বিস্তর ওলটপালট হয়ে গেছে; কিন্তু আমি ঘুরে ঘুরে দেখেছি তার কারণে বিন্দুমাত্র সমস্যা হয়নি। কে বলেছে সবকিছু ঠিক করে কাজ করতে হয়? কয়েকশ’ বাচ্চা যখন আগ্রহ-উৎসাহ নিয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে, তখন অন্য সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেলেও আয়োজনের কোনো রকম ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না।

আমাদের বেশ কয়েকজন বিচারক ছিলেন। তারা সব ঘুরে ঘুরে দেখলেন। যেগুলো তাদের কাছে ভালো মনে হয়েছে, সহজে ও কম খরচে তৈরি করা সম্ভব, সেগুলোকে বেছে বেছে পুরস্কৃত করলেন (পুরস্কারটাও খুব মজার, বিশাল একটা বাক্স বোঝাই রাজ্যের খুঁটিনাটি যন্ত্রপাতি, যেন ছেলেমেয়েরা আরও নতুন নতুন উপকরণ তৈরি করতে পারে)।

এই মুহূর্তে পরিকল্পনা হচ্ছে, ভালো ভালো শিক্ষার উপকরণ তৈরি করে সব স্কুলে বিতরণ করা। দেখা যাক সেটা কতটুকু করা যায়।

এই বিশাল আনন্দযজ্ঞের সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনাটি এখনও বলা হয়নি। সিলেটের সব সংবাদমাধ্যমকে এই অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছিল। তাদের একজনও সেই অনুষ্ঠানে আসেনি। এ দেশের কোনো খবরের কাগজ বা কোনো টেলিভিশনে সেটি দেখানো হয়নি।

আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যম কোন বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে আর কোনটাকে অর্থহীন মনে করে, সেই বিষয়টা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। তাতে অবশ্য ভালো ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে হয় না।

লেখকঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল

Post a Comment

0 Comments