সেই মা কি পারে ঘুমাতে? প্রতি রাতে চমকে
উঠে ভাবে– ঠিক কি করে মারা হলো তার সন্তানকে? কতটা আঘাত সইতে হয়েছে তাকে
কেবল মৃত্যু নিশ্চিতের জন্য? শেষবেলায় কী বলেছিল সে? মাকে ডেকেছিল কি?
একবার দেখবে বলে খুঁজেছিল কি মাকে? শেষ সময়ে মমতার কোনও স্পর্শ পেয়েছিল কি
ছেলেটা? প্রশ্ন, প্রশ্ন আর প্রশ্ন কেবল। মাথায় ঘোরে, দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি
খেয়ে ফিরে আসে বারবার, নিরুত্তর।
শুধু সাম্প্রতিক ইতিহাসেই নয়,
ভবিষ্যতের বাংলাদেশেও বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা এক
নৃশংসতম অপরাধ হিসেবেই আলোচিত হবে। শুধু একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের ‘অপরাধে’
একজন মেধাবী তরুণকে হত্যা করেছে একই প্রতিষ্ঠানের অন্য ছাত্ররা। দীর্ঘ সময়
ধরে পিটিয়ে পিটিয়ে কারও হত্যা নিশ্চিত করা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। এর
জন্য ভিন্ন ধরনের মন-মস্তিষ্কের প্রয়োজন হয়। তাই আবরারকে হত্যা করার এই
নৃশংসতা আমাদের সবাইকে ক্ষতবিক্ষত করেছে, ক্ষুব্ধ করেছে স্বাভাবিকভাবেই।
কয়েক
দিন আগে, শুক্রবার বিকালে ‘আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদ’-এর ব্যানারে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যার তিন বছর
শেষে স্মরণসভার আয়োজন করে ছাত্র অধিকার পরিষদ। সেখানে ছাত্রলীগ হামলা করে
তাদের ধাওয়া দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয়। হামলায় পরিষদের অন্তত ১৫ জন
নেতাকর্মী আহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে
সেখানে গিয়েও তাদের পেটায় ছাত্রলীগ। বিকালে মেডিকেল থেকে পরিষদের বেশ
কয়েকজন নেতাকর্মীকে আটক করে শাহবাগ থানার পুলিশ।
পরদিন ছাত্র
অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের নামে দুটি মামলা করে ছাত্রলীগের দুই নেতা।
রাজু ভাস্কর্যের সামনে মাথায় আঘাত করে জখমের ঘটনায় একজন মামলা করেছেন।
অন্যজন মামলা করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে তাকে ঘুসি দিয়ে
দাঁত ভেঙে ফেলার অভিযোগে। গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের আদালতে তোলা হলে আদালত
ছাত্র অধিকার পরিষদের ২৪ নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়।
ছাত্রলীগের এই বেপরোয়া আচরণ বর্তমান বাংলাদেশের চিত্র। সত্যি বলতে যে ধরনের
রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা বাংলাদেশে কার্যকর আছে, তাতে এটাই হওয়ার কথা।
আবরারের পরিবার এবং এই দেশের কোটি কোটি মানুষকে স্বস্তি দিয়ে অতি
চাঞ্চল্যকর মামলাটির প্রাথমিক রায় হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মামলা
হওয়া, বিচার শুরু হওয়া, বিচার শেষে রায় হওয়া এবং সেই রায় কার্যকর হওয়া এক
বিশাল যুদ্ধ জয়ের মতো ব্যাপার। এই পুরো প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও অনিশ্চিত হওয়া
সত্ত্বেও কলামের আলোচনার স্বার্থে ধরে নিলাম দ্রুতই রায় কার্যকর হয়ে
‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তিও নিশ্চিত হবে। কিন্তু সমাজে অপরাধের প্রকোপ কমাতে
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই যথেষ্ট নয়। তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি বিষয় হলো
অপরাধে যুক্ত মানুষদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে তাদের অপরাধী হয়ে
ওঠার কারণ বোঝার চেষ্টা করে সেটা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া। না হলে কেবল
শাস্তি দিয়ে এই ধরনের বীভৎস অপরাধ দমন করা যাবে না কখনোই।
আবরারের
হত্যাকারীরা কারা, তাদের পরিবার, তাদের বেড়ে ওঠা, তাদের আর্থ-সামাজিক
অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে দেশের বেশিরভাগ মিডিয়া খুব বিস্তারিত রিপোর্টিং
করেনি। তবে এদের কয়েকজন সম্পর্কে কয়েকটি পত্রিকা এবং নিউজপোর্টাল কিছু তথ্য
আমাদের জানিয়েছে। এদের একজন রবিনকে নিয়ে কিছু তথ্য আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ
বলে মনে হয়েছে।
রবিনের বাবা মাকসুদ আলি রাজশাহীর কাপাসিয়া গ্রামের
ভারুয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এবং সে সময় আওয়ামী লীগের
কাটাখালি শাখার ১ নম্বর ওয়ার্ডের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। জনাব মাকসুদ
একটি প্রতিষ্ঠিত নিউজপোর্টালকে বলেছিলেন, তার ছেলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত
থাকা খারাপ কিছু নয়। তিনি বলেন, আমি নিজে রাজনীতি করি এবং আমার ছেলেও করে।
আমাদের মন্ত্রী এবং আইনপ্রণেতারাও যুবক বয়সে রাজনীতি করেছেন। এভাবেই তারা
আজকের রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছেন।
কথা বলেছিলেন রবিনের একজন ভাবিও। তিনি
বলেন, মানুষ ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে যুক্ত হয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য।
ভালো শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকার পরেও অনেকে চাকরি পায় না। কিন্তু রাজনৈতিক
সংশ্লিষ্টতা থাকলে চাকরি পাওয়া যায়।
দেশের এই পরিস্থিতি একটা
বিখ্যাত উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক। পৃথিবীর সর্বোচ্চ ধনী হয়েছিলেন, এমন দু’জন
হলেন আমেরিকার বিল গেটস এবং মেক্সিকোর কার্লোস স্লিম। বিল গেটস ধনী হয়েছেন
যুগান্তকারী কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ আবিষ্কারের মাধ্যমে। আর
কার্লোস মূলত টেলিকম ব্যবসায়ী। বিল গেটস ছিলেন সাধারণ পরিবারের সন্তান। তার
আজকের এই অতি ধনী হয়ে ওঠার পেছনে ছিল তার প্রতিভা, মেধা, দক্ষতা, চিন্তার
উৎকর্ষ আর সর্বোপরি পরিশ্রম। উল্টো দিকে কার্লোস স্লিম পৃথিবীর শীর্ষ
ধনীদের একজন হতে পেরেছিলেন মেক্সিকোর ক্ষমতাসীন সরকারের সরাসরি ছত্রছায়ায়
রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজের অনুকূলে যখন যেভাবে খুশি সেভাবে ব্যবহার করার
মাধ্যমে। মেক্সিকো সরকার যদি সরাসরি কার্লোস স্লিমকে মদত না দিতো, তাকে যদি
মোটামুটি সুস্থ, প্রতিযোগিতামূলক একটি বাজারের মুখোমুখি হতে হতো, তাহলে
শীর্ষ ধনী হওয়া দূরেই থাকুক, তিনি হয়তো মোটামুটি মানের ব্যবসাও দাঁড় করাতে
পারতেন না। মেক্সিকোর সরকার ব্যক্তি কার্লোসকে এতটাই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল
যে কেবল তাকে অন্যায় সুযোগ-সুবিধা দিতে গিয়ে ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল—এই চার
বছরে মেক্সিকোর জাতীয় আয় কম হয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৩ লাখ কোটি টাকারও
বেশি।
পাঠক প্রশ্ন করতেই পারেন, দুনিয়াজুড়ে এত ব্যবসায়ী থাকতে এই
দুজনকে কেন আলাদাভাবে তুলে আনা হলো? হলো এ কারণেই যে তাদের দুজনের উল্টো
পথে হেঁটে একই লক্ষ্যে পৌঁছানোর দুটি ঘটনা কেস স্টাডি হিসেবে উঠে এসেছে
ড্যারন এসেমাগ্লু এবং জেমস এ রবিনসন লিখিত ‘হোয়াই নেশনস ফেইল: দ্য অরিজিনস
অব পাওয়ার, প্রসপারিটি অ্যান্ড পভার্টি’ বইটিতে।
বইটিতে নানান
তথ্য-উপাত্ত-উদাহরণ দিয়ে লেখকরা দেখিয়েছেন কখন, কেন এবং কীভাবে একটি দেশ
ধনী, সমৃদ্ধশালী, জ্ঞান-বিজ্ঞান-গবেষণায় উন্নত হয়, আবার কেনই বা একটি দেশ
যুগের পর যুগ জ্ঞান-বিজ্ঞান-অর্থ-উন্নয়ন-সমৃদ্ধিতে পিছিয়ে থাকে অনেক দূর।
আলোচ্য বইয়ের কেস স্টাডি থেকে দেখা যায়, আমেরিকায় জন্ম বেড়ে ওঠা একটি শিশু
তার পরিবেশ থেকে শৈশবেই বুঝে যায় তার জন্ম যে পরিবারেই হোক না কেন, তার যদি
মেধা, যোগ্যতা, উদ্ভাবনী শক্তি এবং সর্বোপরি পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকে,
তাহলে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে কোনও কিছুই বাধা হতে পারে না। যোগ্যতা
অনুযায়ী সে হতে পারে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী-গবেষক, অথবা সৎ পথে ব্যবসা
করে বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনকুবেরদের একজন। তার সব যোগ্যতা যদি কমও থাকে, তবু
সে তার যোগ্যতা অনুযায়ী লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে। তাই জীবনের প্রাথমিক স্তর
থেকেই তার চেষ্টা থাকে মেধার চর্চা করা, পরিশ্রম করা।
উল্টো দিকে
মেক্সিকোর মতো দেশগুলোয় জন্মে বেড়ে ওঠা একজন শিশু তার আদর্শ হিসেবে পায়
কার্লোস স্লিমের মতো সরকারের অন্যায় পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলেফেঁপে ওঠা একজন
ধনীকে। সেই শিশু দেখে, সমাজে তাকে যদি সফল কিংবা ধনী হতে হয়, তবে তাকে
সরকারের সঙ্গে এক ধরনের অশুভ যোগসাজশ বা আনহোলি নেক্সাস তৈরি করতে হবে। তার
মেধা, উদ্ভাবনী শক্তি কিংবা পরিশ্রমের তেমন কোনও মূল্যায়ন ওই দেশে হবে না।
তাই বেড়ে ওঠার সময় অনেক মেক্সিকানের জীবনের লক্ষ্যই হয়ে দাঁড়ায় কীভাবে
সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার ওই চক্রের মধ্যে ঢোকা যায়। একটা রাষ্ট্রের
বিপুল জনগোষ্ঠী যখন তার মেধা, শ্রম ও উদ্ভাবনী কাজ বাদ দিয়ে সরকারের
নেক্সাসের অংশ হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, তখন সেই জাতির অর্থনীতি এবং অন্য
সবকিছু ধাপে ধাপে ভেঙে পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঠিক একই পরিস্থিতি
বিরাজমান।
অনেক একদলীয় শাসন ব্যবস্থার দেশেও ক্ষমতাসীন দলের লোকজন
কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পায়, কিন্তু অনেক দেশেই নাগরিকদের অধিকার মোটাদাগে
নিশ্চিত করার চেষ্টা হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের
সাথে কোনও না কোনোভাবে যুক্ত না থাকলে তার পক্ষে এই সমাজে অস্তিত্ব রক্ষা
করাই দুরূহ হয়ে পড়ে। ‘দলনিরপেক্ষ’ মানুষদেরও বর্তমান বাংলাদেশে তার যোগ্যতা
অনুযায়ী অবস্থান পাওয়া একেবারেই অনিশ্চিত।
রবিনের ভাবি দ্ব্যর্থহীন
ভাষায় যখন বলেন, ‘মানুষ ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে যুক্ত হয় সুযোগ-সুবিধা
পাওয়ার জন্য’ তখন কথাটিকে নতুন কিছু বলে মনে হয় না। আমরা তখন বুঝি কেনই বা
ছাত্রলীগ এতটা উন্মত্ত হয়ে ওঠে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবরারের স্মরণে একটা
সভায়ও হামলা করে।
এই ঘটনা পরম্পরাই বুঝিয়ে দেয় কেন ইউনিয়ন পরিষদ
নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ের নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের
মধ্যে ভয়ংকর সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে ক্ষমতাসীন দলটির নেতাকর্মীরা।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।
0 Comments
[আর্টিকেলটি ভালো লাগলে সেয়ার করুন]